মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ | ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিশেষ প্রতিবেদন

কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসার নামে চলছে নৈরাজ্য!

শাহীন মাহমুদ রাসেল
১৯ ডিসেম্বর ২০২১

মহান বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটিসহ যোগ হয়ে টানা তিনদিনের ছুটিতে অবকাশ যাপন করতে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে ছুটে এসেছেন কমপক্ষে পাঁচ লাখ পর্যটক। সাথে রয়েছে আরও লক্ষাধিক স্থানীয় দর্শনার্থীদের সমাগম। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সবখানেই লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই কোথাও।

শত কর্মব্যস্ততা ও যান্ত্রিক জীবনকে পেছনে ফেলে এক পশলা বিনোদনের আশায় ছুটে আসা এসব মানুষের সুষ্ঠ বিনোদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে পর্যটন পুলিশের সকল কর্মকর্তা ও সদস্যরা।

তবে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে পুঁজি করে হয়রানি এবং ভোগান্তিও ধারণ করেছে চরম আকারে। আবাসিক হোটেল-মোটেল, গাড়ী পার্কিং, যাতায়াত, দ্রব্যমূল্য ও খাবার রেস্তোরাসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আদায় করা হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য। যেন চলছে অন্যরকম নৈরাজ্য।

এদের মধ্যে কলাতলীস্থ খাবার হোটেল শালিক রেস্টুরেন্ট, লাবনী পয়েন্টস্থ কয়লা রেস্টুরেন্ট এবং হান্ডি’র বিরুদ্ধে উঠে এসেছে অন্তহীন অভিযোগ। মুষ্টিমেয় এই কয়েকটি হোটেল রেস্টুরেন্টের কারণে সমগ্র কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ও দুরদুরান্ত থেকে ছুটে আসা সচেতন পর্যটকবৃন্দ।

প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও পর্যটনের চলতি মৌসুমের বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় হোটেল-মোটেল জোনসহ কক্সবাজার শহরের সবকয়টি আবাসিক হোটেল কক্ষ পূর্বে থেকেই বুকিং করা রয়েছে। এতে হোটেলে ঠাঁই না হওয়ায় আগত দর্শনার্থীদের অনেককে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে যাত্রিবাহী বাস, সৈকতের কিটকটে (বিনোদন ছাতা)। আবার অনেকে সৈকতের খোলা আকাশের নিচে; কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয়দের কারো কারো বাসা-বাড়ীতেও।

এদের মধ্যে সবচাইতে বেশী দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজনদের। থাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় পর্যটকদের অনেককে অবস্থান নিতে হয়েছে কক্সবাজার শহরের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ও উপজেলা সদরেও। এভাবে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে আগত অনেক পর্যটক ভ্রমণসূচী সংক্ষিপ্ত করে ফিরে যাচ্ছেন কক্সবাজার থেকে।

একইভাবে পরিবহন, খাবারের দোকান ও রেষ্টুরেন্টগুলো অস্বাভাবিক দামে পর্যটকদের ঠকাচ্ছে। শহরের কলাতলী মোড় থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ইজিবাইক ও রিক্সা ভাড়া জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা। যদি কেউ পুরো ইজিবাইক নিয়ে আসে তাহলে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করার বিধান রয়েছে। কিন্তু, বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) রিক্সা ও ইজিবাইক চালকরা আদায় করছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা ৩ দিনের ছুটিকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে এখন অবস্থান করছে অন্তত ৪ লাখেরও বেশি পর্যটক। একই সময়ে এতো বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় কিছুটা হয়রানি ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণীর দালাল চক্রযোগসাজশ করে আগে থেকে নিজেদের নামে হোটেল কক্ষ বুকিং করে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে এ ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে বলেও মনে করেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

এছাড়াও টানা ছুটিতে এক সাথে অসংখ্য পর্যটক সমাগম ঘটায় সীমিত জনবল দিয়ে পর্যাপ্ত সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান ট্যুরিস্ট পুলিশের সংশ্লিষ্টরা। তবে দায়িত্ববোধ থেকে তারা বিরামহীন সেবা দিতেও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান প্রতিবেদককে।

কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোন এলাকার আবাসিক হোটেল রিগ্যাল প্যালেসে অবস্থানকারি পর্যটক আবুল কাশেম জানান, ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকুরি করেন। করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর এক প্রকার বন্দি জীবনযাপন করেছেন। টানা ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছেন। কিন্তু হোটেল কক্ষ বুকিং করতে গিয়ে গুনতে হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫গুন বেশী ভাড়া। আমি এর আগেও কক্সবাজার বেড়াতে এসে ওই হোটেলে অবস্থান করেছিলাম। তখন ডাবল-বেডের একটি কক্ষের ভাড়া নিয়েছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু এবার ওই হোটেলে অবস্থান করতে গিয়ে একটি কক্ষের ভাড়া আদায় করতে হয়েছে ৬৫০০ টাকা।

তবে সাভারের নবীনগর থেকে বেড়াতে আসা মোস্তাফা কামাল জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান- কক্সবাজার এসে তাঁর মন জুড়িয়ে গেছে। এবার তিনি বন্ধুদের সাথে দলবদ্ধ ভাবে এসেছেন। দলের ১২জন সদস্যই হোটেলবীচ হলিডেতে উঠেন। সেখানে তাদের আতিথেয়তা তাদের মুগ্ধ করেছে এবং নিয়মিত ট্যারিফে রুম পেয়েছেন। খাবারের মূল্য খানিকটা বেশি মনে হয়েছে। তবুও তিনি পরিবার নিয়ে বারবার কক্সবাজার বেড়াতে আসতে চান। সামনের বার স্বপরিবারে আসবেন বলেও জানান।

এদিকে কক্সবাজার শহরের অলিগলি ও হোটেল মোটেল জোনে চলছে পার্কিংয়ের নামে চলছে চাঁদাবাজি। শুধু মালামাল ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে টোল আদায়ের জন্য বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন যানবাহন ও কুলি স্ট্যান্ড ইজারা নেওয়া হলেও এভাবেই পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। শহরের কবিতা চত্বরে দুই চাঁদাবাজকে স্থানীয়রা গাড়ী থেকে চাঁদা আদায়কালে ধাওয়া করেছে। ওই সময় ২ জন সচেতন তরুণ আহতের ঘটনাও ঘটে। পরে বিষয়টি পুলিশকে অবগত করা হয় বলে জানান নাছির উদ্দিন ও জুয়েল নামেরস্থানীয় দুই যুবক।

টানা ছুটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় প্রতিটি আবাসিক হোটেলেই সবগুলো কক্ষ বুকিং হওয়ায় থাকার জন্য বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা আব্দুল মান্নান নামের এক পর্যটক বলেন, চাকুরির কারণে সারাবছরই ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। এবার টানা ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকায় ৫বন্ধু মিলে কক্সবাজার ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু কক্সবাজার পৌঁছার পর দেখতে পেলাম এই ছুটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক ঘুরতে এসেছেন। অনেক হোটেলে যোগাযোগ করার পরও থাকার জন্য একটি কক্ষও বরাদ্ধ পাইনি। এ পর্যটক বলেন, থাকার জন্য কোথাও ব্যবস্থা না হওয়ায় ৫ বন্ধু মিলে শুক্রবার সৈকতের কিটকট ভাড়া নিয়ে রাত্রিযাপন করবেন।

রাজশাহী থেকে ঘুরতে আসা ইমরুল হাসান বলেন, সেখানকার (রাজশাহী) স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে তারা ৪৫ জনের একটি দল বাস যোগে শুক্রবার কক্সবাজার ঘুরতে আসেন। কিন্তু কোন হোটেল কক্ষ ভাড়া না পাওয়ায় তারা সবাই বাসে রাত্রিযাপন করেছেন।

কিন্তু কক্সবাজার এসে দেখতে পেলাম খাবার থেকে শুরু প্রত্যেকটি জিনিসের অতিরিক্ত দাম গুনতে হয়েছে। এক টুকুরো পোঁয়া মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে দাম দিতে হয়েছে ৩৮০ টাকা। এক লিটার মিনারেল ওয়াটার কিনতে হয়েছে ৫০ টাকায়। গোসল করতে প্রতিজনকে গুনতে হয়েছে ৭০ টাকা। টয়লেট ব্যবহার করতে প্রতিজনকে ৪০/৫০ টাকা করে দিতে হয়েছে। গাড়ি পাকিংয়ের জন্য দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা। তাদের বাসটি ফুটপাতে ছিলো তারপরও তাদের কাছ থেকে এ টাকা এক ধরণের জোর করে আদায় করা হয়েছে বলে দাবী বাস চালক সালাউদ্দিন।

তবে এক শ্রেণীর দালাল চক্রের যোগসাজশের কারণে পর্যটকদের হোটেল কক্ষের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার। তিনি বলেন, টানা ছুটির দিন থাকলে কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটে। এতে বুকিং হয়ে যায় সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেলের সবক’টি কক্ষ। আর বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠে এক শ্রেণীর দালাল চক্রও।

টানা ছুটির দিনগুলোর আগেভাগে দালাল চক্রের লোকজন নিজেদের নামে প্রত্যেকে ৮/১০ টি করে হোটেল কক্ষ বুকিং করে রাখে। এতে এক ধরণের কৃত্রিম সংকটের তৈরী হয়। পরে আগত পর্যটকরা হোটেল কক্ষ বরাদ্ধ না পেয়ে দালাল চক্রের লোকজনের কাছে দ্বারস্ত হতে বাধ্য হন। এতে পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় স্বাভাবিকের চাইতে কয়েক গুন বেশী ভাড়া। তবে এ ধরণের প্রবণতা মালিকদের নিজস্ব পরিচালনাধীন হোটেলগুলোতে নয়। মূলত ভাড়া-উপভাড়ায় পরিচালিত হোটেলে বেশী ঘটে থাকে বলে মন্তব্য করেন এ হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির নেতা। এ ব্যাপারে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর জন্য দাবি জানান আবুল কাশেম সিকদার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু কোরাল রেস্টুরেন্ট বা কয়লা রেস্টুরেন্ট নয়, কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, জোন, বিচ এলাকা, ইনানীসহ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন স্থানে যে চার শতাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে এর মধ্যে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য।

ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপার জিল্লুর রহমান বলেন, টানা ৩ দিনের ছুটিতে এখন কক্সবাজারে ৪ লাখের বেশী পর্যটক সমাগম ঘটেছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে পুলিশের ১৭টি দল দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া ভ্রাম্যমান নিরাপত্তা দলের পাশাপাশি সাদা পোষাকেও পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে ভ্রাম্যমান আদালতও। পর্যটক হয়রানি ও ভোগান্তি নিয়ে কিছু খবর পুলিশ পেলেও বিপুল সংখ্যক আগত লোকজনকে সীমিত জনবল নিয়ে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জাানান ট্যুরিস্ট পুলিশের এ কর্মকর্তা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (পর্যটন সেল) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আগত পর্যটকদের হয়রানি করা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। যেখানেই অভিযোগ পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আশা করি, পর্যটক নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দে কক্সবাজার সৈকত ও অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলো উপভোগ করতে পারবেন। এজন্য কাজ করছে আমাদের একাধিক টিম।’

৫০ বছরে পর্যটকের সংখ্যা একশ গুণ, বেড়েছে পর্যটন কেন্দ্রও
পর্যটনের এগিয়ে চলা

আপনার মতামত লিখুন